• বুধবার ০৩ জুলাই ২০২৪ ||

  • আষাঢ় ১৯ ১৪৩১

  • || ২৫ জ্বিলহজ্জ ১৪৪৫

আজকের খুলনা

রূপসার ২৯ দিনমজুরের ভুয়া ব্যাংক হিসাবে কোটি কোটি টাকা লেনদেন!

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ৩০ জুন ২০২৪  


লিবিয়া ও ইতালীতে লোক পাঠানো এবং কৌশলে সেই সব প্রবাসীদের জিম্মি করে মুক্তিপণে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে আদম ব্যবসায়ী মাফিয়া চক্র। মাফিয়া সিন্ডিকেটের কোটি কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে ডাচ্ বাংলা ব্যাংক লিমিটেড খুলনার রূপসা উপজেলার পালেরহাটস্থ এজেন্ট এ.এ ট্রেডার্স শাখায়। জনৈক মো. আরাফাত ইজারাদারের মালিকাধীন ডাচবাংলা ব্যাংকের পালেরহাট এজেন্ট শাখায় ২৯ জনের ব্যাংক হিসাবে এমন অস্বাভাবিক লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, অস্বাভাবিক লেনদেন হওয়া এসব ব্যাংক হিসাবের প্রায় প্রত্যেকেই দিনমজুর। কেউ কেউ প্রতিবন্ধী ও বয়োবৃদ্ধ। তাদের অভিযোগ, ‘নাম, ঠিকানা, ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে মাফিয়া চক্রটি তাদের অগোচরেই ডাচবাংলা ব্যাংকের পালেরহাট এজেন্ট শাখায় হিসাব খুলে কোটি কোটি টাকা লেনদেন করেছে।’

অন্যদিকে, রূপসা উপজেলার পশ্চিম নন্দনপুর গ্রামের মো. মমিন উদ্দিন মোল্লার ছেলে দিনমজুর হাবিবুর রহমান মোল্লা ও শ্রীফলতলা এলাকার বাকপ্রতিবন্ধী মো. নূর ইসলামের নামের ব্যাংক হিসেবে কিশোরগঞ্জ থেকে এবং রূপসার নন্দনপুর এলাকার দিনমজুর আব্দুল মান্নান ফারাজী ও শ্রীফলতলার কাঠমিস্ত্রি শুভাঙ্কর শিবোর ব্যাংক হিসাবে ময়মনসিং থেকে কোটি কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। এর অভিযোগে আদালতে পৃথক দু’টি মামলা হয়েছে। আদালত স্ব স্ব থানায় তদন্তভার দিলে সেখান থেকে রূপসায় থানায় সরেজমিন তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়। তদন্ত কর্মকর্তা এসব দিনমজুরের বাড়িতে যেয়ে ব্যাংক হিসেবে কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য জানতে চাইলে খনিকের জন্যে হলেও ‘বাকরুদ্ধ’ হয়ে যান তারা। জালিয়াতি করে ব্যাংক হিসাব খুলে কোটি কোটি লেনদেন এবং এ সংক্রান্ত মামলা থেকে প্রতিকার পেতে গত বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) ঢাকার মতিঝিলস্থ ডাচবাংলা ব্যাংকের হেড অব এজেন্ট ব্যাংকিং ডিভিশন, রূপসা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং স্থানীয় শ্রীফলতলা ইউনিয়ন পরিষদে লিখিত অভিযোগ করেছেন দিনমজুররা।

রূপসার পশ্চিম নন্দনপুর গ্রামে যেয়ে কথা হয় দিনমজুর হাবিবুর রহমান মোল্লার সাথে। ৮৭ লাখ ৫৮ হাজার ৩৩০ টাকা লেনদেন হওয়া তার নামের ব্যাংক হিসাব সম্পর্কে কিছুই জানতেন না তিনি। তিনি জানান, তার স্ত্রী জলি বেগমের নামে ২০২৩ সালের ১১ মার্চ স্থানীয় শ্রীফলতলা ইউনিয়ন পরিষদে ভিজিডি কার্ড করার জন্যে ডাচ বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের এজেন্ট ব্যাংকিং পালেরহাট শাখায় একটি হিসাব খোলা হয় (যার নং ৭০১৭৩৩৪৪৭৪২৭০)। হিসাবটিতে বিধিমোতাবেক স্বামী হাবিবুর রহমান মোল্লাকে নমিনি করে তার ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি জমা দেয়া হয়েছিল। প্রতিমাসে মাত্র ২২০ টাকার সঞ্চয় জমা করা হয় সেই হিসাব নম্বরে। গত ২১ মে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে দিনমজুর হাবিবুর রহমান মোল্লার বাড়িতে আসেন ডাচবাংলা ব্যাংকের এজেন্ট শাখার মালিক মো. আরাফাত ইজারাদার ও ডাচবাংলা ব্যাংকের বিভাগীয় অভিযোগ শাখার শীর্ষ এক কর্মকর্তা। 

তারা দু’জন দিনমজুর হাবিবুর রহমানকে বলেন, পালেরহাট এজেন্ট শাখায় তার নামের ব্যাংক হিসাবে এক বছরে অনেক টাকার লেনদেন করেন? এরপর হাবিবুর রহমান মোল্লার চারটি নমুনা স্বাক্ষর নিয়ে যান তারা। পরে খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পারেন, তার নামে ব্যাংক হিসাব ৭০১৭৩৩৬০৯৫২২০ নম্বরে ৮৭ লাখ ৫৮ হাজার ৩৩০টাকা লেনদেন হয়েছে। যার কিছুই জানেন না তিনি। এরকম ভুক্তভোগী শুধু তিনি একা নন, শ্রীফলতলা ইউনিয়ন পরিষদে ভিজিডি কার্ডধারী ২৯ জনের নমিনি’র সাথে ঘটেছে এমনি ঘটনা। তাদের নামে ওই এজেন্ট ব্যাংকের শাখায় হিসাব খুলে কোটি কোটি টাকা লেনদেন করেছে আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্র। দিনমজুর হাবিবুর রহমান আরও জানান, স¤প্রতি পুলিশের মাধ্যমে তারা জানতে পারেন, আমার একাউন্ট থেকে অনেক টাকার লেনদেন হয়েছে। যা বিদেশে লোক পাঠানোর কাজে টাকা লেনদেন এ ব্যবহার করা হয়। আবার কিশোরগঞ্জ জেলা জজ আদালতে লিবিয়া ও ইতালীতে প্রবাসী জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়ের অর্থ গ্রহণ করায় ওই ব্যাংক হিসাবের মালিক হাবিবুর রহমানসহ অন্যদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে (নং ০৯, ০৬-১০-২০২৩ইং)। কিশোরগঞ্জের ভৈরব থানায় ফরওয়াডিং সূত্রে মামলাটির প্রাথমিক তদন্ত করছে রূপসা থানা পুলিশ। রূপসার থানার এএসআই গৌতম কুমার মন্ডল বলেন, ‘ভৈরব থানায় মানবপাচার মামলার একটি তদন্ত এসেছিল। আমি সরেজমিনে যেয়ে দেখেছি-ব্যাংক হিসাবের মালিকরা দিনমজুর, অত্যন্ত নিরীহ প্রকৃতির। ওদের দ্বারা এতো টাকা লেনদেন হওয়া সম্ভব নয়, দিনমজুর আসামীদের ঘরবাড়ির ছবি তুলেও ভৈরব থানার তদন্ত কর্মকর্তা এস আই মাসুদকে পাঠিয়েছি।’

কিশোরগঞ্জের ভৈরব থানার এস আই মো. মাসুদুর রহমান বলেন, “জনৈক হাসিম বাদী হয়ে তার ছেলে সিহাব মিয়া ও জামাই আল আমিনকে লিবিয়ায় মানবপাচার ও জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগে ৯ জনের নাম উল্লেখ করে ভৈরব থানায় মামলা দায়ের করেছেন। আসামীরা সকলেই ভৈরব এলাকার, কিন্তু অর্থ লেনদেনে ব্যবহার করা হয়েছে খুলনা জেলার রূপসা থানাধীন পালেরহাটস্থ ডাচবাংলা ব্যাংকের এজেন্ট শাখার হিসাব। সে জন্যেই ওই ব্যাংক হিসাবের মালিকদের বিষয়ে তদন্ত করা হয়েছে-তদন্তে জানতে পেরেছি, দিনমজুরদের নাম ব্যবহার করে কৌশলে একটি চক্র হিসাব খুলে মানবপাচার ও মুক্তিপণের অর্থ লেনদেন করেছে।” এসব বিষয়ে জানতে এজেন্ট ব্যাংকের মালিক মো. আরাফাত ইজারাদারের আজগড়া গ্রামের বাড়িতে যেয়ে তালাবন্ধ দেয়া যায়। তার প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, ‘ঈদের আগে থেকেই ব্যাংক বন্ধ করে দিয়ে পরিবার নিয়ে কোথায় চলে গেছেন তা জানেন না কেউ।’ এসব বিষয়ে জানতে ডাচবাংলা ব্যাংকের পালেহাট এজেন্ট ব্যাংকের মালিক মো. আরাফাত ইজারাদারের ব্যবহৃত মোবাইলে (০১৭২৩-৫২৮১০৪) কল করলে নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। তবে রূপসা উপজেলার শ্রীফলতলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. ইসহাক সরদার বলেন, ‘বিষয়টা নিয়ে আমরা খুব চিন্তিত। ভিজিডি কার্ডের তথ্য চুরি করে দিনমজুরের নামে ভুয়া ব্যাংক হিসাব খুলে কোটি কোটি টাকা লেনদেন বিষয়টা সত্যিই রহস্যজনক। শ্রীফলতলা ইউনিয়নের অন্তত ১৫ জন এমন অভিযোগ করেছেন। দিনমজুর হাবিবুর রহমানের ৮৭ লক্ষাধিক এবং কাঠমিস্ত্রি শিবোর ১৪ লাখ টাকা লেনদেন-একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার না?’

আজকের খুলনা
আজকের খুলনা