• রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||

  • ভাদ্র ২৪ ১৪৩১

  • || ০৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

আজকের খুলনা

বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগে দিশেহারা উপকূলবাসী, কঠিন হচ্ছে জীবন

আজকের খুলনা

প্রকাশিত: ১৫ জুন ২০২৪  


কয়রা উপজেলার মদিনাবাদ গ্রামে বেড়িবাঁধের পাশে স্ত্রী ও ২ ছেলেকে নিয়ে ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করেন কাঠমিস্ত্রি আইনুদ্দিন গাজী। ঘূর্ণিঝড়ে ২ বার ঘরবাড়িসহ সব হারিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘বারবার ঘূর্ণিঝড়ে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। একটি ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতি কাটিয়ে উঠার আগেই আরেকটি ঝড় আঘাত হানছে, আর আমরা নিঃস্ব হচ্ছি।’
একই উপজেলার দশহালিয়া গ্রামের চিংড়ি ঘের মালিক বারিক গাইন জানান, ঘূর্ণিঝড় রিমালে বেড়িবাঁধ ভেঙে ২০ বিঘা জমির চিংড়ি ঘের তলিয়ে যায় তার। প্রায় ৬ লাখ টাকার মাছ ভেসে যায়। এছাড়া ঝড়ে ভেঙে যায় ঘর। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় হলিই বাঁধ ভাঙে যায়, ঘর ভাঙে যায়, আর আমাইগে কপাল পোড়ে। প্রত্যেকবার ঝড় আসলি আমরা নিঃস্ব হয়ে যাই। এভাবে কতদিন টিকে থাকতি পারবো জানিনে।’
ওই গ্রামের কৃষক জামাল সরদার বলেন, ‘১০ কাঠা জমিতে পুঁইশাক, ঢেঁড়স ও বেগুন লাগিয়েছিলাম। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় রিমালের সময় লবণ পানি উঠে খেত তলিয়ে সব গাছ মরে গেছে। বাধ্য হয়ে এখন অন্যের জমিতে শ্রমিকের কাজ করতে হচ্ছে।’
শুধু এ তিনজনই নয়, একের পর এক ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন খুলনার উপকূলীয় এলাকার কয়েক লাখ মানুষ। কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপ উপজেলায় অসংখ্য মানুষ বারবার নিঃস্ব হচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলীয় এলাকায় ক্রমেই কঠিন হচ্ছে জীবন-জীবিকার লড়াই। প্রায় প্রতিবছর ১ থেকে ২ বার ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ঘরবাড়ি হারাচ্ছে অসংখ্য লোকজন। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাদের ফসলি জমি, চিংড়ি ঘের ও গবাদি পশু। গত ১৭ বছরে ১৭ বার ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সম্মুখীন হয়েছেন উপকূলীয় মানুষ।
কয়রা উপজেলার দশহালিয়া গ্রামের আব্দুল শেখ ও জিনারুল ইসলাম বলেন, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বারবার ফসলি জমি ও চিংড়ি ঘের প্লাবিত হচ্ছে। পানি জমে থাকায় কৃষি জমিতে লবণাক্ততা বেড়েছে। দুর্যোগে পড়ে পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে, বেকার হয়ে পড়ছেন কেউ কেউ।
দশহালিয়া গ্রামের মিজানুর রহমান ও কামরুল ইসলাম জানান, ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, আম্পান, ইয়াসসহ প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়ে আমরা গ্রামের দরিদ্র লোকজন সর্বস্বান্ত হচ্ছি। আবার যখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করি তখনই ঝড় আঘাত হানে, আর আবারও নিঃস্ব হই। মনিরুল ইসলাম জানান, ঝড়ে ৬ বার তার ঘর ভেঙেছে। দিন দিন কয়রা উপজেলা বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠছে।
খুলনার উপকূলীয় উপজেলা কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছায় বসবাস করেন প্রায় ৬ লাখ ৬৫ হাজার মানুষ। বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কেউ স্বস্তিতে নেই।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গত ২৫ ও ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে ২০ হাজার ৭৬২টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ও ৫৬ হাজার ১৪২টি ঘরবাড়ি আংশিক বিধ্বস্ত হয়। জেলা মৎস্য অফিস জানিয়েছে, ৩৫৫ হেক্টর পুকুর, ১০ হাজার ২২৪ হেক্টর চিংড়ি ঘের, ১ হাজার ৫৯০ হেক্টর কাঁকড়া ও কুচিয়া খামার প্লাবিত হওয়ায় প্রায় ১৪ হাজার ৭১ জন মৎস্য চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মৎস্য খাতে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২৪৬ কোটি টাকা। 

কৃষি সম্প্রসারণ অফিস সূত্রে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড় রিমালে ১ হাজার ৬৮ হেক্টর জমির আউশ ধানের বীজতলা, আউশ, পাট, সবজি, ভুট্টা, তিল, মুগডাল, আখ, পান ও তরমুজ প্রভৃতি ক্ষেত পানিতে তলিয়ে যায়। এর ফলে ১৩ হাজার ৭৯৬ জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৪২ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। পুনর্বাসনের জন্য ক্ষতিগ্রস্তরা এখনও পর্যাপ্ত সহায়তা পাননি।

এদিকে ঘূর্ণিঝড় রিমালের জলোচ্ছ্বাসে ৪৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অস্বাভাবিক জোয়ারের পানির চাপ ও বাতাসে বেড়িবাঁধের নদীর দিকের অংশ ক্ষয়ে প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও উপরের মাটি ধুয়ে বাঁধ নীচু হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ সংস্কারের জন্য প্রয়োজন ৬১ কোটি টাকা। এখনও সেগুলো সংস্কার করা হয়নি।   

এ ব্যাপারে খুলনা-৬ (কয়রা-পাইকগাছা) আসনের সংসদ সদস্য মো. রশীদুজ্জামান মোড়ল বলেন, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস মোকাবিলায় টেকসই বেড়িবাঁধ এবং আরও আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।

আজকের খুলনা